কলকাতার বনেদি বাড়ির মধ্যে যদি কারও নাম প্রথমেই আসে, তা হল শোভাবাজার রাজবাড়ি। উত্তর কলকাতার গলিঘুঁজির ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজপ্রাসাদ আজও বাঙালির ঐতিহ্য, ইতিহাস আর গৌরবের প্রতীক। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব শুরু করেছিলেন এই পূজা।
অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২৬৮ বছর আগে শুরু হয়েছিল এই রাজকীয় দুর্গাপূজা, যা আজও একই জাঁকজমকে পালিত হয়।
পলাশীর যুদ্ধ আর পূজার সূচনা
১৭৫৭ সালের সেই ঐতিহাসিক সময়, যখন বাংলার ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছিল, সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর নবাবি শাসনের অবসান ঘটে, তখনই ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। এই প্রেক্ষাপটে রাজা নবকৃষ্ণ দেব যিনি ছিলেন বুদ্ধিমান ও কূটনৈতিক এক জমিদার ভাবলেন, ইংরেজদের জয় এবং দেবীর আশীর্বাদকে এক সঙ্গে যুক্ত করা যাক। তাই তিনি দুর্গাপূজার সময় আয়োজন করলেন এক বিশাল উৎসব, যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন লর্ড রবার্ট ক্লাইভ স্বয়ং সেই থেকেই শুরু হয় কলকাতার রাজকীয় দুর্গাপূজার ইতিহাস শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রথম দুর্গাপূজা।
প্রথম পূজার রাজকীয় আয়োজন
প্রথম বছর থেকেই এই পূজার আভিজাত্য ছিল চরমে। লর্ড ক্লাইভ, ইংরেজ অফিসার ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য লখনউ, কাশ্মীর ও পারস্য থেকে আনা হত নামকরা বাঈজি। তাঁদের নাচ-গানে মাতত রাজবাড়ির প্রাঙ্গণ। সময়ের সঙ্গে সেই জায়গা নিয়েছে নাটক, সংগীত ও কবিতা পাঠের আসর।
তবে এই সব আড়ম্বরের মধ্যেও পূজার পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ শাস্ত্রসম্মত ও নিয়মানুবর্তী। পুরোহিতেরা আজও সেই পুরনো মন্ত্রপাঠ ও রীতিনীতি অনুসারে দেবীর আহ্বান করেন।
দুই তরফে দুই পূজা
বর্তমানে শোভাবাজার রাজবাড়িতে হয় দুটি আলাদা দুর্গাপূজা:
একটি রাজা নবকৃষ্ণ দেবের দত্তক পুত্র গোপীমোহন দেবের বংশধরদের “বড় তরফে”,
আর অন্যটি তাঁর নিজ সন্তান রাজকৃষ্ণ দেবের বংশধরদের “ছোট তরফে”।
দুটি বাড়িরই পূজা আজও তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। থিম-নির্ভর পূজোর যুগেও এদের শাস্ত্রীয় রীতি বদলায়নি। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত রাজবাড়ির দরজা খোলা থাকে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য। এই সময় পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ভিড় করেন এই ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদে।
দেবী দুর্গা কেন পর্দার আড়ালে?
শোভাবাজার রাজপরিবারের পূজার একটি বিশেষ প্রথা হল দেবীকে পর্দার আড়ালে রাখা। কিংবদন্তি বলে, দেবী দুর্গাকে এখানে “কন্যা” রূপে দেখা হয়। তাই বাইরের কেউ যেন সরাসরি মায়ের মুখ না দেখতে পায়, সেই কারণেই প্রতিমার সামনে থাকে পর্দা।
এই পূজা বৈষ্ণব মতে হওয়ায় দেবীকে ভোগে ভাত দেওয়া হয় না। তার বদলে থাকে শুকনো খাবার ও নানা মিষ্টি সিঙাড়া, কচুরি, নিমকি, গজা, জিলিপি, পানতুয়া প্রভৃতি। রাজবাড়ির রান্নাঘর থেকে তখন ভেসে আসে ঘি আর মিষ্টির মনভরা গন্ধ।
ঐতিহ্যের ছোঁয়া আজও অটুট
প্রায় তিন শতাব্দী পেরিয়েও শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপূজা আজও বাঙালির শ্রদ্ধা আর গর্বের জায়গায় রয়েছে। প্রতিটি বছর হাজারো মানুষ এখানে আসেন কেউ ইতিহাস দেখতে, কেউ ঐতিহ্যের সাক্ষী হতে, কেউ বা শুধু মায়ের আশীর্বাদ নিতে।
রাজবাড়ির প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি শাঁখধ্বনি আর প্রতিটি ঢাকের আওয়াজ যেন বলে
“এখানেই জন্ম নিয়েছিল কলকাতার রাজকীয় দুর্গাপূজা সংস্কৃতি।”
আর আজও, মা দুর্গা এখানে শুধু প্রতিমায় নন তিনি আছেন ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে, আর প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।
জয় মা দুর্গা!