বাংলা সাহিত্যের হাসির জাদুকর শিবরাম চক্রবর্তী: যাঁর কলমে ছিল জীবনের মিষ্টি ব্যঙ্গ

shibram chakraborty

shibram chakraborty

বাংলা সাহিত্যের পাতায় যদি এমন কাউকে খুঁজতে চাও, যিনি একসঙ্গে হাসাতে আর ভাবাতে পারেন  তাহলে নাম আসবে একটাই, শিবরাম চক্রবর্তী। কলকাতার ভাষায় বললে, উনি ছিলেন একেবারে “ভিন্ন ধাঁচের মানুষ”  না বড়লোক, না সেলিব্রিটি, তবু মানুষকে হেসে-কেঁদে ভালোবাসতে শিখিয়ে গেছেন।

শিবরাম মানেই কৌতুক, শব্দখেলা, ব্যঙ্গ আর একরাশ মিষ্টি দারিদ্র্য যেটা তিনি পরিণত করেছিলেন সাহিত্যের রসে। তাঁর কলমে হাসি মানে ছিল না শুধু মজা, ছিল জীবনের এক গভীর দৃষ্টি। এই ব্লগে আমরা ঘুরে দেখব সেই মানুষটাকে যিনি নিজের জীবনের কষ্ট, একঘেয়েমি, আর দারিদ্র্যকেও রূপ দিয়েছেন বাংলা রম্যসাহিত্যের অমূল্য সম্পদে।

প্রারম্ভিক জীবন

শিবরাম চক্রবর্তীর জন্ম ১৩ ডিসেম্বর ১৯০৩ চাঁচল, মালদহ পশ্চিমবঙ্গ। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হলেও, ছোট থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল সাহিত্য আর দেশভক্তিতে। স্কুলজীবনেই তিনি বিপ্লবী চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে কিছুদিন পড়াশোনা করলেও, লেখালিখি আর দেশসেবাই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের আসল লক্ষ্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে একাধিকবার তাঁকে জেলেও যেতে হয়। আর সেই জেলের দিনগুলোই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর সাহিত্যজীবনের যাত্রা।

সাহিত্যজীবনের শুরু

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই শিবরাম লিখতে শুরু করেন। তাঁর লেখা প্রকাশিত হতো দেশ, পরিচয়, মশাল প্রভৃতি পত্রিকায়। তবে তাঁর আসল পরিচয় গড়ে ওঠে হাস্যরসাত্মক লেখার মাধ্যমে। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জীবনে হাসি সবচেয়ে বড় ওষুধ, আর সাহিত্য হতে পারে সেই হাসির বাহন।

তাঁর লেখার ভাষা ছিল একদম সাধারণ চলতি বাংলা, কিন্তু এমনভাবে লেখা যে পাঠক হাসতে হাসতেই ভাবতে বাধ্য হতেন।

লেখার ধরন বৈশিষ্ট্য

শিবরামের লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর আত্ম-উপহাসের ক্ষমতা। তিনি নিজের দারিদ্র্য, ব্যর্থতা কিংবা মজার অভিজ্ঞতাগুলো এমনভাবে লিখতেন যে পাঠক একই সঙ্গে হাসতেন ও ভাবতেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তির মতো “আমি গরিব, কিন্তু গরিবি নিয়ে গর্ব করি না গরিবি আমার নিজের নয়, ভাগ্যের দান।” তাঁর এই সহজ রসবোধই তাঁকে বাংলা সাহিত্যের এক অমর চরিত্রে পরিণত করেছে। তাঁর লেখায় ছিল ব্যঙ্গ, বুদ্ধিদীপ্ত শব্দখেলা আর সমাজজীবনের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ।

শিবরামের বিখ্যাত রচনা

শিবরাম চক্রবর্তী মূলত রম্য প্রবন্ধ, আত্মজীবনীধর্মী গল্প আর হালকা মেজাজের উপন্যাস লিখতেন। তাঁর জনপ্রিয় বইগুলোর মধ্যে আছে:

  • এগারো পথে বারো ঘাটে
  • একখানা খাতা
  • অভিজ্ঞতার আবর্জনা
  • সদর দরজা খোলা
  • বেতাল পঞ্চবিংশতি (আধুনিক রূপে)
  • হাসির রাজ্যে শিবরাম
  • চলতি কথার কেচ্ছা

এইসব লেখায় তিনি এমনভাবে নিজের জীবন আর চারপাশের মানুষকে তুলে ধরেছেন, যে হাসির মাঝেও পাঠক টের পান জীবনের কঠিন বাস্তবতা।

চরিত্র নির্মাণে তাঁর মুন্সিয়ানা

তাঁর গল্পের চরিত্রগুলো একদম বাস্তব জীবনের কাছাকাছি হারাধন, বরখা, চঞ্চল, কিংবা নিজেই ‘শিবরাম’।
এই চরিত্রগুলো মজার হলেও, হৃদয়ের গভীর থেকে টান দেয়। পাঠক যেন তাঁদের মধ্যেই নিজেদের একটা অংশ খুঁজে পান।

তিনি দেখিয়েছেন হাস্যরস মানে শুধু হাসি নয়, এটা একধরনের শিল্প, যা সমাজ আর মানুষের মনস্তত্ত্বের ভেতরে পৌঁছে যায়।

জীবনযাপন দারিদ্র্য

জীবনের শেষ পর্যন্ত শিবরাম চক্রবর্তী থেকেছেন একেবারে সাধারণ মানুষ হিসেবে।
কলকাতার এক ছোট ঘরে প্রায় নির্জনভাবে কাটিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। টাকা-পয়সা বা আরাম-আয়েশে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না।

তাঁর একমাত্র সম্পদ ছিল তাঁর কলম আর সেই অদ্ভুত হাস্যরসের জাদু।
দারিদ্র্যকে তিনি দুর্ভাগ্য নয়, বরং রচনার উপাদান বানিয়েছিলেন।

আরো পড়ুন: রাজকোটের আগুনে ঝলসে গেল বাঙালির স্বপ্ন

মানুষ মন

শিবরাম ছিলেন ভীষণ নম্র আর নিরহংকার মানুষ।
খ্যাতি বা পুরস্কারের জন্য তিনি লেখেননি লেখা ছিল তাঁর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
তাঁর হাসি কখনো হালকা ছিল না; ছিল গভীর মানবিকতার ছোঁয়া।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন দারিদ্র্য মানে অখুশি নয়, বরং জীবনের রস আসলেই সেখানেই।

সাহিত্যজগতে প্রভাব

যে সময় শিবরাম লিখতে শুরু করেন, তখন বাংলা সাহিত্য মানে ছিল গুরুগম্ভীরতা আর রোমান্টিক ভাব।
সেই প্রেক্ষাপটে তিনি পাঠককে নতুনভাবে হাসতে শেখালেন চিন্তা করতে করতে হাসা, আর হাসতে হাসতে চিন্তা করা।

পরবর্তীকালে তাঁর প্রভাব দেখা যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, এমনকি হুমায়ুন আহমেদের লেখাতেও।

শেষ জীবন

জীবনের শেষ দিকে শিবরাম প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা, আর্থিক অনটন আর বয়সের ভার সব মিলিয়ে কষ্টে ছিলেন।
তবুও তাঁর কলম থামেনি। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি লিখেছেন, মজা করেছেন, মানুষকে হাসিয়েছেন।
১৯৮০ সালের ২৮ আগস্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা সাহিত্য সেদিন হারায় এক অনন্য হাসির কারিগরকে।

উত্তরাধিকার প্রাসঙ্গিকতা

আজকের দিনে যখন হাসি অনেক সময়ই কৃত্রিম হয়ে যায়, তখন শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা আমাদের শেখায়
সহজভাবে জীবনকে ভালোবাসা, দুঃখের মধ্যেও হাসতে পারা, আর প্রতিটা মুহূর্তে জীবনের রস খুঁজে নেওয়া।

তাঁর সাহিত্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
হাসি মানে পালানো নয়, এটা একধরনের দৃঢ়তা, জীবনের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ।

শিবরাম চক্রবর্তী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক চিরসবুজ গাছ যাঁর ছায়ায় মেলে হাসি, ব্যঙ্গ, ভালোবাসা আর জীবনের সহজ সত্য। তিনি ছিলেন শুধু একজন রম্যরচয়িতা নন, ছিলেন একজন দার্শনিক যিনি শিখিয়েছেন,
“দুঃখেও হাসা যায়, কষ্টেও রস আছে।”তাঁর কলম আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
সাহিত্য শুধু ভাবনা নয়, হাসির মধ্যেও জীবনের সত্যকে প্রকাশ করার এক অসাধারণ সাধনা।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *