ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক গল্প

ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

ভারতের ইতিহাসে কিছু নাম আছে, যেগুলো কেবল বইয়ের পাতায় নয়, মানুষের মনে গেঁথে আছে গভীর শ্রদ্ধায়। তেমনই এক নাম ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কলকাতার সন্তান, যিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজসংস্কারক এবং দেশপ্রেমিক নেতা।

দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যখন ভারত নিজের পথ খুঁজছিল, তখন ড: মুখোপাধ্যায় তাঁর অদম্য সাহস আর অটল বিশ্বাস দিয়ে দেখিয়েছিলেন, দেশসেবা মানে শুধু রাজনীতি নয় এটি জাতির প্রতি এক নিঃস্বার্থ অঙ্গীকার। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান যেমন অনন্য, তেমনই দেশের ঐক্য ও সংহতির প্রশ্নে তাঁর অবস্থান ছিল দৃঢ় ও স্পষ্ট। নীতির সঙ্গে আপস না করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলে দাঁড়ানো এটাই ছিল তাঁর চরিত্রের মূল ভিত্তি। আজও তাঁর নাম উচ্চারিত হলে মনে পড়ে যায় এক নির্ভীক নেতার ছবি যিনি দেশকে ভালোবেসেছিলেন নিঃস্বার্থভাবে, এবং সেই ভালোবাসার জন্যই ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়: জন্ম ও পরিবার

ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ৬ জুলাই, ১৯০১ সালে কলকাতায়, ব্রিটিশ ভারতের সময়ে।
তাঁর পিতা ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত উপাচার্য ছিলেন।
মাতা ছিলেন সুধা দেবী। স্ত্রীর নামও সুধা দেবী, এবং তাঁদের পাঁচটি সন্তান ছিল তিনটি কন্যা ও দুটি পুত্র।

শিক্ষা পেশাগত জীবন

ছোটবেলা থেকেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। পড়াশোনার প্রতি গভীর আগ্রহ আর শৃঙ্খলাবোধ তাঁকে দ্রুতই অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বিএ, এরপর বাংলা সাহিত্যে এমএ এবং পরে আইনশাস্ত্রে বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরপর, ১৯২৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান এবং লিঙ্কনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। দেশে ফিরে এসে আইন পেশায় যোগ দেন, তবে শুধু পেশাগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকেননি সমাজ ও শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নতির জন্যও সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, অর্থাৎ ১৯৩৪ সালে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক সংস্কারমূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার ফলে শিক্ষার মান ও পরিবেশ দুই-ই নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।

রাজনৈতিক জীবন

ড. মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ১৯২৯ সালে, যখন তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩৯ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৪১-৪২ সালে বেঙ্গল প্রদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, তিনি ১৯৪৭ সালে জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভায় ভারতের প্রথম শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।
তবে, ১৯৫০ সালে নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বিরোধিতা করে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

এরপর ১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP)-এর ভিত্তি স্থাপন করে।

কাশ্মীর তাঁর মৃত্যু

১৯৫৩ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা (ধারা ৩৭০) নিয়ে ড. মুখোপাধ্যায় দৃঢ় অবস্থান নেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, “এক দেশে দুটি সংবিধান, দুটি প্রধানমন্ত্রী এবং দুটি জাতীয় প্রতীক থাকতে পারে না।”
এই অবস্থান থেকে তিনি কাশ্মীরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন, এবং সেখানে গ্রেপ্তার হন।

১৯ জুন, ১৯৫৩ তারিখে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং ২৩ জুন, ১৯৫৩ সালে শ্রীনগরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু আজও ভারতের ইতিহাসে এক রহস্য ও বেদনাময় অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।

উত্তরাধিকার স্মৃতিস্তম্ভ

ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকে ধরে রাখতে দেশের নানা প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু প্রতিষ্ঠান ও স্মারক:

  • শ্যামাপ্রসাদ কলেজ, কলকাতা (প্রতিষ্ঠিত ১৯৪৫ সালে)
  • . শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়, রাঁচি (২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়)
  • . শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সিভিক সেন্টার, দিল্লি (২০১০)
  • . শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ইনডোর স্টেডিয়াম, গোয়া (২০১৪)

আরো পড়ুন: জ্যোতীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী: ঠাকুর পরিবারের নীরব কিন্তু উজ্জ্বল নক্ষত্র

ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এক দৃঢ়চেতা, দেশপ্রেমিক নেতা, যিনি ভারতের ঐক্য, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদে অবিচল ছিলেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে একনিষ্ঠতা, সাহস ও দেশপ্রেম দিয়ে জাতির সেবা করা যায়। আজও তাঁর নাম উচ্চারণ করলে দেশের মাটিতে দেশপ্রেমের সুর বেজে ওঠে।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *